আজ ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মায়ার বাঁধন-সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক:

আমার ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। যেমনি ছেলের বউ চেয়েছি তেমনি বউ পেয়েছি। লক্ষী আমার বউ মা। কিন্তু কপালে বৌমার সুখ সইল না। ছেলের আমার অকালেই মৃত্যু হলো দুই মেয়ে রেখে। আজিজার প্রাণ ফেটে যায় কষ্টে। বাকি জীবন কিভাবে পাড়ি দিবে আমার পুত্রবধূ।
মালিহা সীমাহীন কষ্টের মধ্যেও শাশুড়িকে সান্তনা দেয়, আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন মা। তিনিই সব ব্যবস্থা করে দিবেন। আমাদের জমিজমা যেটুকু আছে গায়ে খেটে করলেই ভালই চলবে।
তা তো বুঝলাম বৌমা। এ সংসারের দায়ভার সম্পূর্ণ তোমার উপর। আমার ছেলে খোকনও যে ছোট সংসারের হাল ধরবে সেই বয়সও তো ওর হয় নাই।
মা আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সংসারের সবকিছুই সামাল দিতে পারব। শুধু আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বৌমা দোয়া অবশ্যই করি। তুমি মেয়ে মানুষ হইয়া ক্ষেত খামার সামলাও। সংসারের রুজি-রোজগারে একমাত্র ভরসা তুমি।
মা নিজেদের ক্ষেত খামারে কাজ করি তাতে সমস্যা কি! মালিহা ক্ষেতের তরিতরকারি বিক্রির জন্য বাজারে যায়। তা দিয়ে সংসারের সদাই নিয়ে আসে। বাড়িতে এসে রান্না সারে। আজিজার কাজ দুই নাতি দিয়া,মিলা আর ছেলে খোকনকে সামাল দেয়া। মালিহার নিজের দুই সন্তানের চেয়ে দেবর খোকনের প্রতি যেন ভালোবাসা বেশি। খোকনকে নিজের সন্তানের মত যত্ন-আত্তি করে। খোকন কোন কিছু একবার মুখে ফুটে বললে, যত কষ্টই হোক সে তা হাজির করে। খোকন পড়ালেখা শিখে মস্ত বড় অফিসার হবে এটা মালিহার আশা।


শাশুড়ি আজিজা বলে, বৌমা তোমার দুই মেয়ে আছে তাদের দিকেও খেয়াল রেখো, ওদের নিয়েও চিন্তা ভাবনা করো।
মা ওদের বিয়ে দিলে ওরা চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি। খোকন সোনা ওই তো আমাদের বংশের প্রদীপ।
শাশুড়ি সস্নেহে তাকায়। তাই বলে, মেয়েদের অবহেলা করতে নাই। সংসারের দায়িত্ব তুমি বুঝে নিতে পেরেছ এখন আমি মরেও শান্তি পাব।
মা এই কথা বলে, আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিলেন।
ভয় পাবা কেনো মা? একদিন তো আমাকে বিদায় নিতেই হবে!
মরণ যদি আসে ধরে তো রাখতে পারব না। তবু আপনি এমন কথা বলবেন না।
নিয়তির পরিহাস আজিজা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে যায়। মৃত্যু আগ মুহূর্তে তাঁর মনের শেষ ইচ্ছার কথা বলে। বৌমা আমি চলে যাচ্ছি আমার আপন ঠিকানায়। আমার খোকন বাবাকে তোমার কাছে রেখে গেলাম তুমি ওকে দেখে রেখো।
মা এভাবে বললেন না আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে।
ডাক যখন এসেছে তখন তো যেতেই হবে। মালিয়া দুই মেয়েকে কাছে ডেকে। দিয়া আর মিলা দু’জনেই দৌড়ে এসে দাদির কাছে বসে। খোকনও এসে মায়ের পাশে বসে। আজিজা খোকনের হাতটা মালিহার হাতে তুলে দেয়। বাবা খোকন বড় ভাবি মায়ের মত তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি।
মালিহা বলে, মা আপনাকে কথা দিলাম খোকনকে আমি নিজ সন্তানের মত লালন-পালন করব।
আজিজা এই কথা জেনে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করে।
মালিহার শাশুড়ির মৃত্যুর পর শূন্য অন্তর আরো শূন্য হয়ে ওঠে, ভাবে মায়ের মত শাশুড়ির ছিল সেও আজ নেই। মালিহা নিজের দুই মেয়েকে খেলো না খেলো তার দিকে খেয়াল নেই। খোকনের খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত হলো কিনা সেদিকেই তার খেল। খোকনের জন্য আলাদা করে খাবার তুলে রাখে। দিয়া আর মিলা যদি কখনো সে খাবার খেতে চায় মালিহা চিৎকার করে ওঠে ওটা চাচ্চুর জন্য তোমরা ধরবেনা। মায়ের নিষেধ শুনে দিয়া আর মিলা আর খাবারে হাত দেয় না। মালিহা সবার পড়ালেখা করতে হিমশিম খেতে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে দিয়া আর মিলা পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়।
মালিহাকে সবাই বলে, খোকন তোর নিজের পেটের সন্তান না। তোর দুই মেয়ে আছে তাদের কথা একটু ভাব। দেবরের জন্য জমিজমা সব শেষ করছিস। খোকন বিয়ে করলে ওর বউ তোর এই মহিমা নিয়ে কীর্তন করবে না!
মালিহা এ কথা শুনে ক্ষিপ্ত কন্ঠে উত্তর দেয়। তোমরা যে যাই বলো আমি আমার দায়িত্ব পালন করেই যাবো।

খোকন পড়ালেখা শেষ করে পুলিশের চাকরি পায়। সে বিয়ে করবে, বিয়ের জন্য ভাবিকে মেয়ে দেখতে বলে। মালিহা খুশি হয়ে দেবর এর জন্য মেয়ে দেখে। মেয়েও পেয়ে যায়। ভারী মিষ্টি চেহারার মেয়ে এলিনা। খোকনের সঙ্গে মানাবে বেশ। দুপক্ষের গার্জিয়ানদের সম্মতিতে খোকন আর এলিনা বিয়ে হয়। এলিনা বাবা মায়ের অতি আদরের একমাত্র মেয়ে। বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলাতে চায়না। বাবার বাড়িতে যেমন ছিল বরের বাড়িতেও তেমনি থাকতে চায়। সংসারের কোন কাজ সে করতে চায়না। স্বামীকে বলে, তোমার আগের আমলের ঘর এ ঘরে আমার থাকতে ভালো লাগে। তোমাকে নতুন ঘর দিতে হবে।
তোমাকে আমি নতুন ঘর করে দিব।
সেই ঘরে কিন্তু তোমার ভাবি তার মেয়েরা থাকতে পারবে না।
তারা থাকতে পারবে না। ভাবির অবদানে আজ আমার এই জীবন।
তোমার ভাগের জমি দিয়ে পড়ালেখা করিয়েছে?
এসব কি বলছো ভাগাভাগি কথা।
আমার স্বামীর যেখানে এক টাকা সেখানে খরচ হচ্ছে দুই টাকা এটা আমি সহ্য করবো না।
বউয়ের কথা কারো কাছে বলতেও পারে না। কষ্টে খোকনের মনটা ভারী হয়ে ওঠে।

মালিহার দুই মেয়ে বিয়ের সমতুল্য। বড় মেয়ে দিয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। দিয়াকে দেখে ছেলে পক্ষের পছন্দ হয়। ছেলের বাবা মাইনুদ্দিন জানায় মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে কিন্তু দেনাপাওনা বলে তো কিছু আছে। সামান্য কিছু এই ধরেন পঞ্চাশ হাজার টাকা আর ঘরের আসবার পত্র।
মালিহা থমকে যায়। এই দাবি মেটানোর ক্ষমতা তার নেই। উপায়ন্তর না পেয়ে দেবর খোকনকে জানায়। তোমার ভাইঝির বিয়ের ঘর এসেছে। তাদের কিছু চাওয়া-পাওয়ার আছে।
জেনে খুবই খুশি হলাম। ছেলেদের চাওয়া-পাওয়া কি?
পঞ্চাশ হাজার টাকা আর ঘরের আসবার পত্র।
ভাবি আমার সামর্থ্য আছে। আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করব। ভাইঝির প্রতি আমার দায়িত্ব কর্তব্য আছে না।
ভাই আমি চিন্তা মুক্ত হলাম।
এলিনা এ কথা শুনে জ্বলে ওঠে। দাঁড়াও তোমার দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করাচ্ছি। স্বামীর সঙ্গে চেঁচামেচি করে। ভাইঝির বিয়েতে কোন টাকা পয়সা খরচ করতে পারবেনা তুমি? কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হলে আগে আমার কাছ থেকে মত নিবে।
তোমার মত নিয়ে আমার সিদ্ধান্ত নিতে হবে? খোকনের রাগ দেখে এলিনা বলে, দেখো আমি এখানে আর থাকতে চাই না আমাকে আমার বাপের বাড়ি দিয়ে এসো। মনে মনে বলে, দাঁড়াও আমার বাপের বাড়ি যেয়ে তারপর তোমার এখানে আসা আমি বন্ধ করব। এলিনাকে দিয়ে আসে তার বাপের বাড়ি খোকন। এলিনা বলে, তুমি যদি এই দিয়ার বিয়ের ব্যাপারে কোনো টাকা-পয়সা খরচ করো তাহলে তুমি আমাকে পাবে না।
খোকন বলে, দেখো বাবা হারা মেয়েটাকে এত বড় শাস্তি দিওনা। আমি যদি টাকা-পয়সা না দেই, ভাবির এমন কোন সামর্থ্য নেই তা দিয়ে সে মেয়ের বিয়ে দিবে। এই ভাবির কারণে আজ আমি এই পর্যায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
এতো ভাবি ভাবি করো কেন? ভাবীর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? ভাবি আর তার সন্তানের সঙ্গে কোন যোগাযোগ তুমি রাখতে পারবিনা।
আহত খোকন চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা। অপবাদ দিচ্ছ ভাবি যে আমার মা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব না। তাও তুমি শান্তিতে থাকো। খোকন চলে যায় তার চাকরির কর্মস্থানে।
ভাবির প্রতি বদনাম দেওয়ায়, ভাবি আর তার দুই সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করে না খোকন। মালিহা দেখে মেয়ের বিয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। খোকনেরও কোন খোঁজ পাচ্ছেনা। মালিহা দিশেহারা হয়ে পড়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। কোন কিছু ভেবে না পেয়ে এলিনার বাপের বাড়ি যায়। এলিনার সঙ্গে কথা বলে। কিরে ছোট খোকন তো কোন যোগাযোগ করছে না। এদিকে মেয়ের বিয়ের টাকা ফার্নিচার কোন কিছুই তো জোগাড় হলো না।
এই কথা শুনে এলিনা রেগে যায়। এখানে এসেছেন কেন? এসবকিছু খোকন দিতে পারবে না। খোকন আপনার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখতে চায়না। টাকা ফার্নিচার কোথা থেকে জোগাড় করে মেয়ের বিয়ে দিবেন সেটা আপনি জানেন। খোকনকে ছেলে বলেন, তার সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক আমি সবই বুঝি!
মালিহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! কেঁদে বলে, এসব কথা বলিস না। তাহলে দুনিয়া থেকে মা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি তুমি ভালো থাক।
দিয়ার বিয়ের বরযাত্রী আসে। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াবে এমন সময় মাইনুদ্দিন থামেন কাজী সাহেব। আগে দেওনা-পাওনা বুঝে নেই তারপর হবে বিয়ে।
মালিহা বলে মাইনুদ্দিনকে ভাই আমি কিছুই জোগাড় করতে পারিনি। আপনি বিয়ার শুভ কাজে বাধা দিয়েন না। আমার বাড়ি যেটুক জমি আছে বিক্রি করে আপনার দেনা পাওনা শোধ করে দিবো।
তা হবেনা বাকি কাজ ফাঁকি। ছেলে মিলনকে বলে, ওঠ এ বিয়ে হবে না।
মিলন বলে, বাবা আমি এখানে বিয়ে করবো। মইনুদ্দিন ছেলেকে ধমক মেরে তোর বিয়ে আমি করাচ্ছি? ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যায়।
মালিহা বলে, ভাইসাব আমার এত বড় সর্বনাশ করবেন না আমি লোকজনের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবো। কে শোনে কার কথা মইনুদ্দিন একবারও পিছনে ফিরে তাকালো না। মালিহা মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় দুঃখে-কষ্টে চিৎকার করে কান্নাকাটি করে। দিয়া বলে, এখন কান্নাকাটি করো কেন? জায়গা জমি সব শেষ করেছ দেবরের জন্য। এখন কাঁদো বসে বসে।

কিছুদিন পর মালিহা জানতে পারে খোকন তার শ্বশুর বাড়ি এসেছে। অতি আগ্রহ নিয়ে দেবরের সঙ্গে দেখা করার জন্য যায়। এলিনা দূর থেকে দেখে মালিহা আসতেছে। সামনে হাজির হয়ে আপনি এখানে এসেছেন কেন? সে মোক্ষম অস্ত্র টি ব্যবহার করে। তাহলে কি ধরে নেব খোকনের সঙ্গে আপনার অবৈধ সম্পর্ক!
এই কথা বলিস না এটা যে পাপ। আমাকে একবার শুধু খোকনের মুখটা দেখতে দে।
আমি তা কখনোই দেব না।
খোকন আড়াল থেকে দেখে ভাবি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছে। দেখা তো করতে পারছেই না উল্টা অপমান লাঞ্ছনা জর্জরিত হচ্ছে। নিভৃতে খোকনের দু’চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
আমার সন্তান তুই আমার কাছ থেকে দূরে রাখছোস। তুইও কোনদিন সন্তানের মুখ দেখবিনা। “মায়ার বাঁধন” ছেড়ে কেউ কখনো দূরে যেতে পারেনা তাই খোকনও আমার কাছ থেকে দূরে না সবসময় আমার হৃদয়ে থাকবে।

মালিহার দুই মেয়ে দেখতে সুন্দর হাওয়া খুবই ভালো জায়গায় বিয়ে হয়। দুই মেয়ের জামাই সুজন আর জাহিদের সংসারে তারা খুব ভালোই আছে। মালিহা মেয়েদের ঘরে নাতির মুখ দেখেছে। তের বছরের মাথায় হঠাৎ খোকন আর এলিনা এসে হাজির। এলিনা পায়ে জড়িয়ে ধরে মালিহার। ভাবি আপনি আমাকে মাফ করে দেন। আমি আপনার সঙ্গে অন্যায় করেছি এর কোন ক্ষমা নেই। কান্নাকাটি করে।
মালিহা বলে, মায়ের কাছে সন্তান কখনো অন্যায় করতে পারেনা। মা যে ক্ষমাশীল।
ভাবি আমি যে আপনার সন্তান কেড়ে নিয়েছি। তেমনি আমিও সন্তানের মুখ দেখতে পাইনি।
এই কথা বলিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভাবি আমাকে আপনার কাছে ঠাই দেন। এরপর সবাই মিলে একসঙ্গে থাকে। হাসি খুশিতে ভরে ওঠে তাদের সংসার। মালিহার দুঃখ ভুলে আনন্দে হৃদয় ভরে ওঠে।

লেখক-সুলেখা আক্তার শান্তা

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ